Saturday, September 16, 2017

  1. ইমামের পশ্চাতে মুক্তাদির কিরাআত না

                         পড়া   সম্পর্কে


    কিরাআত’ শব্দের অর্থ পাঠ করা । নামাযের মধ্যে বিশেষ স্থানে পবিত্র কোরআন হতে কিছু অংশ পাঠ করাকে শরীয়াতের পরিভাষায় ‘কিরাআত’ বলা হয় । নামাযে কিরাআত পাঠ করা ফরয । কিরাতের সর্বিনিম্ন পরিমাণ ছোট তিন আয়াত বা বড়া এক আয়াত । নামাযী স্বীয় সঙ্গতি অনুসারে কিরাআতকে দীর্ঘও করতে পারে । কিন্তু ইমামের পশ্চাতে মুক্তাদি সূরা ফাতিহা এবং অন্য কোণ কিরাআত পড়বে না । বরং নামাযের ধ্যানে ইমামের কিরাআত শুনতে থাকবে অথবা চুপ করে থাকবে । সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা পাঠ শুধু ইমামের দায়িত্ব । ইমাম আযম আবূ হানীফা (রহঃ) এর মতে কোন অবস্থায়ই ইমামের পিছনে মূকতাদের সূরা ফাতিহা ও অন্য আয়াত তিলাওয়াত করা জরুরী নয় । নিচে এর প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হলঃ
    ১) পবিত্র কোরআনের সূরা আ’রাফ এ ইরশাদ হয়েছেঃ
    আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা নিবিষ্ট চিত্তে শুনবে এবং চুপ করে থাকবে, যাতে তোমাদের উপর রহমত হয় ।
    — সূরা আল-আ’রাফ আয়াত নং ২০৪
    এই আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছেযে, এই হুকুমটি কি নামাযের কোরআন পাঠ সংক্রান্ত, না কোন বয়ান-বিবৃতিতে কোরআন পাঠের ব্যাপারে, নাকি সাধারণভাবে কোরআন পাঠের বেলায়, তা নামাযেই হোক অথবা অন্য যে কোন অবস্থায় হোক । অধিকাংশ মুফাসসেরীনের মতে এই-ই যথার্থ যে, আয়াতের শব্দগুলো যেমন ব্যাপক, তেমনি এই হুকুমটিও ব্যাপক ।
    কতিপয় নিষিদ্ধ স্থান বা কাল ব্যতীত যে কোন অবস্থায় কোরআন পাঠের ক্ষেত্রে এই নির্দেশ ব্যাপক । উল্লেখ্য যে, কতিপয় তাফসীরকার উক্ত আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে নিম্নোক্ত মন্তব্য পেশ করেছেনঃ
    • ইমাম বাগাবী তাফসীরে মুয়াল্লেমুত্তানযীন-এ লিখেছেন যে, একদল বিদ্বান বলেন- উপরোক্ত আয়াতটি নামাযের কিরাতের সম্বন্ধে অবতীর্ণ হয়েছে । অর্থাৎ ইমামের পশ্চাতে কিরাআত নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য নাযিল হয়েছে ।[1]
    • তাফসীরে ইবনে কাসীরে আছে, আলী ইবনে তানহা বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ননা করেছেন যে, উক্ত আয়াতের অর্থ এই যে, যে সময় ফরয নামাযে কোরআন তিলাওয়াত করা হয়, সে সময় তোমরা (মুকতাদিগন) শ্রবণ কর ও নীরব থাক ।[2]
    • ইমাম মুজাহিদ বলেন, নবী করিম (সাঃ) নামাযে কোরআন পাঠ করছিলেন, তখন তাঁর পশ্চাতে যুবক কোরআন পড়ছিলেন, সেই সময় উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল ।[2]
    • ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী তাফসীরে দুররে মানসুরে লিখেছেন-
    ইমাম আবূ বিন হুমাইদ ও ইমাম বায়হাকী কিরাআতের অধ্যায়ে হযরত আবুল আলিয়া হতে বর্ননা করেছেন- নবী করীম (সঃ) যে সময় নামাযে কোরআন পাঠ করতেন সে সময় সাহাবাগণও (মুক্তাদি) কোরআন পড়তেন, সেহেতু উক্ত আয়াত নাযিল হয়েছিল । তৎপরে নবী করিম (সঃ) নামাযে কিরাআত পাঠ করতেন, কিন্তু মুক্তাদি সাহাবাগণ কিরাআত পাঠ করতেন না ।
    — তাফসীরে দুররে মানসুরে
    • এ ছাড়া সাইদ বিন মুসাইয়েব, মুহাম্মদ বিন কা’ব জুহুরী, ইব্রাহীম, হাসান বলেন, উক্ত আয়াত নামায সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল ।
    ২) ‘মিশকাতুল মাসাবীহ্‌’ হাদীস গ্রন্থ হতে সংগৃহীত হয়েছেঃ
    হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত আছে,
    একবার রাসুলুল্লাহ (সঃ) এরূপ এক নামায হতে অবসর গ্রহণ করলেন যাতে তিনি জেহরী (আওয়াজ) কিরাআত পড়েছিলেন । অতঃপর বললেনঃ তোমাদের মধ্যে কি কেউ এখন আমার সাথে কিরাত পড়েছ ? একব্যক্তি উত্তর করলঃ জ্বি, ইয়া রাসূলাল্লাহ্‌! তা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ আমি নামাযে মনে মনে বলতেছিলাম আমার কী হল, কোরআন পড়তে আমি এরূপ টানা হেঁচড়া অনুভব করতেছি কেন ? আবূ হুরায়রা বলেন, যখন লোকেরা রাসূল (সঃ) এর মুখে এটা শুনল, তখন হতে তারা জেহরী নামাযে (ইমামের পিছনে) করাত পড়া হতে বিরত হয়ে গেল ।
    — মালেক, আহমদ, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহ্‌
    ইমাম আযম আবূ হানীফার (রহঃ) মতে এই হাদীস দ্বারা ইমামের পিছনে কিরাআত পড়ার সমস্ত হাদীস মানসূখ হয়ে গিয়েছে ।
    ৩) মুসলিম, আবূ দাউদ, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহ হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত আছেঃ
    হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেনঃ
    রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ইমাম এজন্যই নির্ধারিত হয়েছেন যাতে তার অনুসরণ করা হয় । সুতরাং যখন ইমাম আল্লাহু আকবার বলবে তোমরাও আল্লাহু আকবার বলে এবং যখন তিনি কোরআন পড়বেন তোমরা চুপ থাকবে ।
    [3]
    ৪) মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ ও শরহে মাআনিউল আছার গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছেঃ
    হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হুযুর (সঃ) এরশাদ করেছেনঃ যে বক্তি ইমামের পশ্চাতে নামায পড়ে, ইমামের কিরাআত তার (মুক্তাদির) কিরাআত বলে গণ্য হবে ।
    [4]
    ৫) মুসলিম শরীফে উল্লেখ হয়েছেঃ
    হযরত আবূ হুরায়রা ও হযরত কাতাদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে,
    যখন (ইমাম) কিরাআত পড়ছেন, তখন তোমরা (মুক্তাদি) চুপ থাকবে । এতে মুক্তাদিগণের পক্ষে কিরাআত পাঠ করা ঠিক নয় ।
    [5]
    ৬) দারে কুত্‌নী গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছেঃ
    হযরত শা’বী বর্ননা করেছেন,
    নবী করিম (সঃ) এরশাদ করেছেন, ইমামের পশ্চাতে মক্তাদির কোন কিরাআত নাই ।
    [6]
    ৭) উক্ত কিতাবে আরও উল্লেখ হয়েছেঃ
    হযরত আলী (রাঃ) বর্ননা করেছেন,
    এক ব্যক্তি নবী করীম (সঃ)কে বললেন, আমি কি ইমামের পিছনে কিরাআত পড়ব, না চুপ থাকব ? নবী করিম (সঃ) বললেন, চুপ থাকবে । কেননা ইমামের কিরাআতই তোমার জন্য যথেষ্ট ।
    [6]
    ৮) মুয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে,
    হযরত ইবনে হযরত ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে,
    জনৈক ব্যক্তি তার নিকট ইমামের পিছনে কিরাআত পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ অর্থাৎ যখন তোমাদের মধ্যে কেউ ইমামের পিছনে নামায পড়ে, তখন ইমামের কিরাআত তার জন্য যথেষ্ট । হযরত ইবনে উমর (রাঃ) নিজেই ইমামের পিছনে কিরাআত পড়তেন না ।
    [7]
    ৯) তাহাবীতে আছেঃ
    হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্নিত । তিনি বলেন,
    নবী করিম (সঃ) এরশাদ করেছেনঃ যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে কিরাআত পড়ে থাকে, তার মুখ যদি মাটি দ্বারা বন্ধ করে দেয়া হত (তবে ভালই হত) ।
    [8]
    ১০) মুসনাদে ইমাম আযম আবূ হানীফা হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত আছেঃ
    এক রেওয়ায়েতে আছে,
    এক ব্যক্তি নবী করিম (সঃ) এর পিছনে যোহর অথবা আসর নামাজে কিরাআত পাঠ করে, তখন এক ব্যক্তি ইঙ্গিতে এটা পড়তে নিষেধ করে । যখন তিনি নামায থেকে অবসর হলেন তখন বললেনঃ তুমি কি আমাকে নবী করিম (সঃ) এর পিছনে নামায পড়া থেকে বাধা প্রদান করছ ? অতঃপর উভয়ে এটা নিয়ে তর্ক করতে লাগল । এমনকি নবী করিম (সঃ) এটা শুনে ফেললেন, তখন তিনি বললেন- যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে নামায পড়বে এই অবস্থায় ইমামের কিরাআত তার কিরাআত হবে । অর্থাৎ মুক্তাদি হিসেবে তার কিরাআত পড়বে হবে না ।
    [9]
    ১১) মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছেঃ
    হযরত আবূ মূসা (রাঃ) এবং হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত আছে-
    রাসূল (সঃ) এরশাদ করেছেনঃ ইমাম যখন কোরআন পড়বে, তোমরা চুপ করে থাকবে ।
    ইমাম মুসলিম, ইমাম আহ্‌মদ, ইমাম ইবনে জারীর, ইমাম মুনযির ও ইমাম ইবনে হাযেম উক্ত হাদীস বিশুদ্ধ বা সহীহ বলে বর্ননা করেছেন । হযরত ইবনে আব্দুল বার ও ইবনে তাইমিয়ার এই হাদীস স্বীয় কিতাবে বর্ননা করেছেন ।[10]
    ১২) ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছেঃ
    হযরত আলী (রাঃ) বলেছেনঃ
    যে ব্যক্তি ইমামের পশ্চাতে কিরাআত পড়ে, সে যেন (দ্বীনের কাজে) ভুল করলো ।
    [11]
    ১৩) তিরমিযী শরীফে বর্নিত হয়েছেঃ
    হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্নিত আছে,
    তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা ব্যতীত নামায পড়ল, তার নামায হয় নাই । কিন্তু ইমামের পশ্চাতে নামায পড়লে তার জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করার প্রয়োজন নাই । ইমাম তিরমিযী (রহঃ) এই হাদিসকে হাসান সহীহ্‌ বলে অভিহিত করেছেন ।
    [12]
    ১৪) সহীহ মুসলিম শরীফে উল্লেখ হয়েছেঃ
    কোন ব্যক্তি হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ইমামের পশ্চাতে কোরআন পড়তে আছে আছে কিনা ? তদুত্তরে তিনি বললেন, ইমামের পশ্চাতে (মুক্তাদিদেরকে) কোন নামাযেই কোরআন পড়তে হবে না ।
    [13]
    ১৫) মুসলিম শরীফ উদ্ধৃত হয়েছেঃ
    হযরত আবূ হুরায়রা ও হযরত কাতাদা (রাঃ) বর্ননা করেন যে,
    নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ ইমাম যে সময় কোরআন পাঠ করেন, তোমরা (মুক্তাদিগণ) চুপ করে থাক ।
    ইমাম মুসলিম বলেন, এই দিসটি আমার নিকট সহীহ্‌ বা বিশুদ্ধ ।[14]
    ১৬) ‘ফতহুল কাদীর’ কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে যে,
    ইমাম মুজাহিদ বর্ননা করেছেন যে, নবী করীম (সঃ) নামাযে কোরআন পাঠ অবস্থায় (তাঁর পশ্চাতে) জনৈক আনসারী (মদিনাবাসী) যুবককে কোরআন পড়তে শুনলেন, সে সময় উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়েছিল । যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা নিবিষ্ট চিত্তে শুনবে এবং (সর্বদা) চুপ থাকবে ।
    [15]
    ১৭) উক্ত কিতাবে আরও উদ্ধৃত হয়েছে যে, ইমাম বায়হাকী বর্ননা করেনঃ
    আলিমগণের এজমা হয়েছে যে, উক্ত আয়াতটি নামাযের সম্বন্ধেই নাযিল হয়েছে । অর্থাৎ মুক্তাদিগণকে ইমামের কোরআন পাঠের সময় নীরব থাকার জন্য নাযিল হয়েছে ।
    [16]
    ১৮) আবূ দাউদ শরীফে উল্লেখ হয়েছেঃ
    যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা এবং অন্য কিছু না পড়ে, তার নামায হবে না ।
    ইমাম সুফিয়ান বলেন, এটা যিনি একাকী না পড়েন তার জন্য ।[17]
    ১৯) মুয়াত্তায়ে মালেক হাদীসগ্রন্থে আছেঃ
    জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ
    যে ব্যক্তি এক রাকআত নামায পড়ল; এতে সূরা ফাতিহা পড়লো না, সে যেন নামায পড়ল না । কিন্তু ইমামের পশ্চাতে মুক্তাদিগণকে পাঠ করতে হবে না ।
    [18]
    ২০) হযরত আবূদ্দারদা (রাঃ) হতে নাসায়ী শরীফে বর্নিত আছেঃ
    আমি বিশ্বাস করি- ইমাম কিরাআত পড়লে মুক্তাদিগণের কিরাআত পড়া হয়ে যাবে ।
    [19]
    ২১) নাসায়ী শরীফে বর্নিত আছেঃ
    ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) বলেন,
    নিশচয়ই হযরত নবী করিম (সঃ) যোহর ও আসর পড়েছিলেন এবং এক ব্যক্তি তার পশ্চাতে কোরআন পড়েছিলেন । নবী করিম (সঃ) নামায শেষ করে বললেন, তোমাদের মধ্যে কোণ ব্যক্তি সূরা ‘আলা’ পাঠ করেছো ? ঐ দলের মধ্যে এক ব্যক্তি বললেন- আমিই পড়েছি । কিন্তু সদুদ্দেশ্যেই পড়েছি । এতে নবী করিম (সঃ) বললেন, আমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছি যে, তোমাদের মধ্যে কেউ আমার কিরাআতের মধ্যে বিঘ্ন ঘটিয়েছ ।
    [19]
    উক্ত হাদিসের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইমাম চুপে চুপে কিরাআত পড়লেও মুক্তাদিও কোন কিরাআত পাঠ করবে না । ঠিক তেমনি জাহরিয়া নামাযে যেমন মাগরিব, এশা ও ফজরে মুকতাদি কিরাআত পড়বে না । এই মর্মে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে হাদীস বর্নিত হয়েছে ।
    ২২) হাফেযে হাদীস মাওঃ আব্দুর রশীদ গঙ্গুহী বলেনঃ
    ইমামের পিছনে মুকতাদির কিরাআত পাঠ করা ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় ছিল । পরবর্তি সময় 'ওয়া ইযা ক্বুরিয়াল ক্বুরআনু' এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর উক্ত বিধান রহিত হয়ে গেছে ।
    [20]
    ২৩) বুখারী শরীফের শরাহ্‌ ফয়যুল বারীতে আছে,
    ইমাম ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেনঃ
    হুযুর (সঃ) ইনতিকালের পূর্বে তিন দিন পর্যন্ত তিনি জামাআতে যাওয়া হতে বিরত ছিলেন । উক্ত সময় হযরত আবূ বকর (রাঃ) জাহরী নামাযের ইমামতি করছিলেন । হুযুর (সঃ) যখন মসজিদে আগমন করলেন তখন হযরত আবূ বকর (রাঃ) নামাযের মধ্যেই পশ্চাতে গেলেন । নবী করিম (সঃ) ইমামতির জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলেন । হযরত আবূ বকর (রাঃ) যে পর্যন্ত কিরাআত পড়তেছিলেন, সেখান থেকে কিরাআত পাঠ করা শুরু করলেন । উক্ত অবস্থায় নবী করীম (সঃ) সূরা ফাতিহা দোহ্‌রান নাই । যদি সূরা ফাতিহা পাঠ রুকন হত যা পাঠ না করলে নামায হয় না, তবে হুযুর (সঃ) সূরা ফাতিহা অবশ্যই দোহরাতেন । হুযুর (সঃ) শেষ জীবনে ‘ফাতিহা’ ছাড়া নামায কেমন করে পড়লেন ? তাঁর জীবনে শেষ আমলের দ্বারা জানা গেল যে, সূরা ফাতিহা ইমামই পাঠ করবেন । ইমামের কিরাআত পাঠ অর্থ মুক্তাদির কিরাআত পাঠ করা । সুতরাং কিরাআত পাঠ ইমামের পিছনে মুক্তাদির জন্য জরুরী নয় । কিরাআত পাঠের হুকুম মনসুখ (রহিত) হয়ে গেছে । সেহেতু যদি কেউ ইমামকে ফাতিহা পাঠের পরে পায় বা রুকুতে পায়, তখন সূরা ফাতিহা বা অন্য সূরা কিভাবে পড়বে । এতে প্রমাণিত হয় যে, ইমামের পিছনে মুকতাদির কিরাআতের প্রয়োজন নেই ।
    — ফয়যুল বারী
    ২৪) যুক্তিতর্কেও বুঝা যায় যে, ইমাম সমস্ত মুকতাদির পক্ষ হতে উকিল । সূরা ফাতিহা খোদার শিখানো দরখাস্ত, যা ইমাম সাহেব সকলের পক্ষ হতে প্রভুর দরবারে আবেদন-নিবেদন করে থাকেন । দরখাস্তে (সূরা ফাতিহা) শেষ হয়ে গেলে সকলেই আমীন বলে থাকেন । যেমন বাদী-বিবাদীর পক্ষ হতে হাকিমের (বিচারক) নিকটে একজন উকিল বর্ননা দিয়ে থাকেন । উকিলের কথাই সকলের কথা । হাকিমের সম্মুখে প্রত্যেকে বর্ননা দেন না এবং উকিলই দিয়ে থাকেন । অনুরূপ ইমাম সাহেব মাত্র একাই সকলের পক্ষ হতে প্রভুর কাছে দরখাস্ত পেশ করেন । মুক্তাদিগণ নয় ।
    ২৫) পবিত্র কোরআন ও বর্নিত হাদীসসমূহের দ্বারা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, কিরাআত ও সূরা ফাতিহা পাঠ করার দায়িত্ব ইমামের । কিন্তু একাকী নামায পড়লে সূরা ফাতিহা ও কিরাআত উভয়ই পড়তে হবে । ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) এর মতে উচ্চস্বরের নামায হোক যেমন ফজর, মাগরিব, ঈশা ও জুমুয়া এবং নিম্নস্বরের নামায যেমন যোহর ও আসর কোন অবস্থাতেই ইমামের পশ্চাতে মুক্তাদির সূরা ফাতিহা ও কিরাআত পড়তে হবে না । একই মত পোষণ করেছেন হযরত আবূ তালিব, হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ, হযরত জায়েদ বিন সাবিত, হযরত আলী বিন আবূ তালিব, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ, হযরত সুফইয়ান সওরী, হযরত সুফিইয়ান ইবনে উয়ায়াইনা, ইবনে আবি লাইলা, ইবনে আব্বাস, আবূ সাইদ খুদরী, হাসানবিন সালেহ ও ইব্রাহীম নাখয়ী প্রমুখ সাহাবা ও তাবীঈগণ । আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি বলেনঃ প্রথম যুগের মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবাদের ৮০ জন ইমামের পশ্চাতে কিরাআত পাঠ না করার পক্ষ সমর্থন করেছেন ।[21]
    উপরের বর্ননাসমূহের দ্বারা স্পষ্টরূপে বুঝা গেল যে, হানাফিগণ ইমামের পশ্চাতে সূরা ফাতিহা ও কিরাআত না পড়ার সিদ্ধান্ত কোন মনগড়া খেয়াল খুশীমত করেন নাই । বরং পবিত্র কোরআন, হাদীস, তাফসীর অনুযায়ী ইমামের পশ্চাতে সূরা ফাতিহা ও অন্য কোন সূরা বা আয়াত না পড়ার আমল করে থাকেন । তবে উল্লেখ্য যে, ইমামের কিরাআতের শব্দ কর্ণগোচর হলে মুক্তাদিগন আগ্রহ সহকারে শ্রবণ করবে । কিরাআতের শব্দ শুনতে পাওয়া না গেলে মুক্তাদি শুধু চুপ বা নীরব থেকে নামাযের ধ্যানে দাঁড়িয়ে থাকবে । হানাফী ইমাম ও ফকীহ্‌গণের এটাই সিদ্ধান্ত ।[22]

    তথ্যসূত্র


  2. সাইফুল মুকাল্লেদীন, কৃত মাওঃ ইবরাহীম মুহাব্বাতপুরী, পৃঃ ৩৯ । এবং তুহফাতুল মু’মিনীন, কৃত মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী, পৃঃ ৮৪ ।

  3. তুহফাতুল মু’মিনীন, পৃঃ ৮৫ ।

  4. তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ৩১৫, ৩৭৪, ৩৭৫ ।

  5. ইবনে মাজা, পৃঃ ৭১; তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩১৭ এবং মুয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ (ঊর্দূ), পৃঃ ৫৯

  6. সহীহ মুসলিম, পৃঃ ১৭৪

  7. তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ৩১৯ ।

  8. মুয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ (ঊর্দূ), পৃঃ ৫৬

  9. আনোয়ারুল মুকাল্লেদীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ৪৬ এবং তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ৩২১ ।

  10. মুসনাদে ইমাম আ’যম আবূ হানীফা, হাদীস নং ১০৪ ।

  11. আনোয়ারুল মুকাল্লেদীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ৪৪ ।

  12. তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ৩১২ ।

  13. তিরমিযী, পৃঃ ৪২ এবং মুয়াত্তায়ে মালেক, পৃঃ ২৮ ।

  14. সহীহ্‌ মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২১৫ ।

  15. সহীহ্‌ মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৭৪ ।

  16. ফতহুল কাদীর, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৭ ।

  17. ফতহুল কাদীর, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৭ ।

  18. আবূ দাউদ শরীফ, পৃঃ ১৪৬ ।

  19. মুয়াত্তায়ে মালেক, পৃঃ ২৮ এবং সাইফুল মুকাল্লেদীন, কৃত মাওঃ ইবরাহীম মুহাব্বাতপুরী, পৃঃ ৬২।

  20. নাসায়ী শরীফ, পৃঃ ২৪৬ ।

  21. তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ৩২৯ ।

  22. বঙ্গানুবাদ মুসনাদে ইমাম আ’যম আবূ হানীফা, পৃঃ ১৩৯ ।

  23. হানাফীদের কয়েকটি জরুরী মাসায়েল (লেখকঃ মাওলানা মোঃ আবু বকর সিদ্দীক)

No comments:

Post a Comment

ভাল একটি মন্তব্য করার জন্য শুকরিয়া